কুরআন ও হাদিস ইসলামি শরিয়তের প্রধান দুটি উৎস। ইসলামি শরিয়তের সকল বিধি-বিধান ও নিয়ম পদ্ধতি মূলত এ উৎসদ্বয় থেকেই গৃহীত। কুরআন মজিদ ও হাদিস শরিফে মানব জীবনের সকল সমস্যার মৌলিক নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে। এসব মূলনীতির আলোকেই ইসলামের সকল বিধি-বিধান প্রণীত হয়েছে। কুরআন ও হাদিসের নীতিমালার বাইরে কোনো কিছু ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হলে কুরআন মজিদ ও হাদিস শরিফ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এ অধ্যায়ে আমরা আল-কুরআন ও হাদিসের কতিপয় বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করব।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
■ আল-কুরআনের পরিচয়, গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও শিক্ষা বর্ণনা করতে পারব।
■ তাজবিদের নুন সাকিন ও তানবিন, মীম সাকিনের নিয়ম বর্ণনা করতে পারব।
■ বিশুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াতে আগ্রহী হব ও পাঠ করতে পারব।
■ নির্বাচিত পাঁচটি সূরার পটভূমি (শানে নুযুল) বর্ণনা করতে পারব । নাযিরা তিলাওয়াতের আদব ব্যাখ্যা করতে পারব।
■ বিশুদ্ধ উচ্চারণে কুরআনের সূরা আল-কাদর, আল-যিলযাল, আল-ফিল, কুরাইশ এবং আন-নাস্অ র্থসহ মুখস্থ বলতে ও মূল বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে পারব।
■ আয়াতুল কুরসি ও সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত মুখস্থ বলতে এবং অর্থ লিখতে পারব । নৈতিক ও আদর্শ জীবন গঠনের ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে পারব।
■ মোনাজাতমূলক তিনটি হাদিস অর্থসহ বর্ণনা করতে পারব।
■ নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে হাদিসের গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারব।
■ কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা অনুযায়ী সামাজিক ও নৈতিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ হব।
পরিচয়
কুরআন শব্দটি আরবি। এটি কারউন শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। কারউন অর্থ পড়া বা পাঠ করা। অতএব, কুরআন শব্দের অর্থ হলো পঠিত। আল-কুরআন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পঠিত কিতাব। প্ৰত্যেক দিনই লক্ষ-কোটি মুসলমান এ গ্রন্থ তিলাওয়াত করে থাকে। আমরা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে এ গ্রন্থ থেকে বিভিন্ন সূরা ও আয়াত পাঠ করে থাকি। এ জন্য এ কিতাবের নাম রাখা হয়েছে আল-কুরআন। ইসলামি পরিভাষায়, আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য হযরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উপর যে কিতাব নাজিল করেছেন তাকেই আল-কুরআন বলা হয়। এটি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। সর্বকালের সকল মানুষের জন্য এ কিতাব হিদায়াতের উৎস।
আল-কুরআন ‘লাওহি মাহফুযে' বা সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ । এটি প্রথমে কদরের রাতে প্রথম আসমানের ‘বায়তুল ইয়্যাহ’ নামক স্থানে এক সাথে নাজিল করা হয় । এরপর সেখান থেকে আল-কুরআন আমাদের প্রিয়নবি (স.)-এর উপর নাজিল করা হয়। মহানবি (স.)-এর ৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকাকালে সর্বপ্রথম সূরা আলাকের ৫টি আয়াত অবতীর্ণ হয়। তারপর রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবদ্দশায় প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে নাজিল করা হয়। এভাবে ২৩ বছরে খণ্ড খণ্ড আকারে পুরো কুরআন নাজিল হয়।
আল-কুরআনের সূরাসমূহ দুইভাগে বিভক্ত । যথা- মক্কি ও মাদানি। মহানবি (স.) আল্লাহর নির্দেশে নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। নবি করিম (স.)-এর এ হিজরতের পূর্বে নাজিল হওয়া সূরাসমূহ মক্কি সূরা হিসেবে পরিচিত। এ সূরাসমূহে সাধারণত আকাইদ সংক্রান্ত বিষয়সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন- তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত, বেহেশত-দোযখ, কিয়ামত ইত্যাদি হলো মক্কি সূরাগুলোর বিষয়বস্তু। অন্যদিকে মহানবি (স.)-এর মদিনায় হিজরতের পর নাজিলকৃত সূরাসমূহকে মাদানি সূরা বলা হয়। এ সূরাসমূহে সালাত, যাকাত, সাওম, হজ, জিহাদ, হালাল-হারাম, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।
আল-কুরআনের বেশ কিছু নাম রয়েছে । আল-কুরআনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আলোকে এ নামসমূহ রাখা হয়েছে । এগুলো আল-কুরআনের বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে । নিম্নে এর কতিপয় নাম উল্লেখ করা হলো-
ক. আল-ফুরকান (পার্থক্যকারী) : আল-কুরআন সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী। এ জন্য একে আল-ফুরকান বলা হয়।
খ. আল-হুদা (হিদায়াত, পথপ্রদর্শন) : কুরআন মজিদের মাধ্যমে ন্যায় ও সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করা হয় বলে একে আল-হুদা নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
গ. আর রাহমাহ (রহমত, দয়া, করুণা) : পবিত্র কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য রহমত ও করুণাস্বরূপ। তাই একে রাহমাহ বলা হয়েছে।
ঘ. আয-যিকর (উপদেশ, আলোচনা) : কুরআন মজিদে বহু ঘটনার আলোচনা ও বহু উপদেশ রয়েছে। তাই একে যিকর নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ঙ. আন-নুর (জ্যোতি, আলো) : পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে হালাল-হারামের রহস্য উদ্ভাসিত হয়, তাই একে ‘নুর' বলা হয়।
কুরআন মজিদ ৩০টি (ত্রিশটি) ভাগে বিভক্ত । এর প্রতিটি ভাগকে এক একটি পারা বলা হয়। এর সূরা সংখ্যা মোট ১১৪টি। এগুলোর মধ্যে ৮৬টি সূরা মক্কি এবং ২৮টি সূরা মাদানি । আল-কুরআনে সর্বমোট ৭টি মনজিল, ৫৪০টি রুকু ও ১৪টি সিজদার আয়াত রয়েছে। এর আয়াত সংখ্যা সর্বমোট ৬২৩৬টি, মতান্তরে ৬৬৬৬টি।
আল-কুরআনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
আল-কুরআন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহাগ্রন্থ । আল-কুরআন আমাদের আল্লাহ তায়ালার পরিচয় দান করে। আমরা আল্লাহ তায়ালাকে চিনতাম না। তাঁর ক্ষমতা ও গুণাবলি সম্পর্কে জানতাম না। আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে আমাদের প্রিয়নবি (স.)-এর উপর কুরআন মজিদ নাজিল করেন। মহানবি (স.) আমাদের আল-কুরআন শিক্ষা দেন। ফলে আমরা আল্লাহ তায়ালার পরিচয় লাভ করি। তাঁর আদেশ- নিষেধ জানতে পারি। কী কাজ করলে তিনি খুশি হন আর কোন কাজ করলে তিনি অসন্তুষ্ট হন তাও জানতে পারি। আল-কুরআন না থাকলে এগুলো সম্ভব হতো না। অতএব বোঝা গেল যে, মানব জীবনে আল-কুরআনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
আল-কুরআন মানব জাতির হিদায়াতের প্রধান উৎস। কোন পথে চললে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করবে আল-কুরআন তা আমাদের দেখিয়ে দেয়। পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ ইত্যাদির পরিচয় দান করে। আল-কুরআনের নির্দেশনামতো চলে আমরা কল্যাণ লাভ করতে পারি। আখিরাতে আল-কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। দুনিয়াতে যে ব্যক্তি আল-কুরআনের নির্দেশ মেনে চলবে সে হবে মহাসৌভাগ্যশালী। সে পাবে চিরশান্তির জান্নাত। আর যে কুরআন মজিদের আদেশ নিষেধ মানবে না তার স্থান হবে যন্ত্রণাদায়ক জাহান্নামে৷
আল-কুরআন আমাদের নৈতিক ও মানবিক আদর্শ শিক্ষা দেয়। আল-কুরআন অনুসরণ করে আমরা উত্তম চরিত্রবান ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারি । ফলে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি ইত্যাদি দূরীভূত হবে।
কুরআন মজিদ সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। এটি কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা নির্দিষ্ট জাতির জন্য নাজিল হয় নি। বরং এটি সর্বজনীন ও সর্বকালীন মহাগ্রন্থ। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আসবে সকলের হিদায়াতের জন্য এ কুরআন নাজিল হয়েছে।
আল-কুরআনের শিক্ষা
কুরআন মজিদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস। এটি যাবতীয় জ্ঞানের ভাণ্ডার। এছাড়া মানুষের জীবনে যেসব সমস্যার উদ্ভব হয়ে থাকে তার সমাধানের ব্যাপারে এতে ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
অর্থ : “আমি এ কিতাবে কোনো কিছুই বাদ দেই নি।” (সূরা আল-আনআম, আয়াত ৩৮)
আল-কুরআনের সকল জ্ঞান ও শিক্ষাই সুস্পষ্ট। সংক্ষিপ্ত ও প্রামাণ্য। এতে উল্লেখিত সকল প্রকার আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান সমগ্র বিশ্বের সকল মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য, যুগোপযোগী ও যুক্তিসংগত। এ কিতাবে কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই। এটি সকল প্রকার ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে। আল-কুরআনের প্রথমেই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
অর্থ : “এটি সেই কিতাব, যাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২)
আল-কুরআন ইসলামি শরিয়াহ'র প্রধান উৎস। মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন কেমন হবে তা এ কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। মানুষ কীভাবে ইবাদত করবে, কীভাবে চরিত্র গঠন করবে তাও এ কিতাবে উল্লেখ রয়েছে। প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ (র.)-এর মতে, আল-কুরআনে বহু জ্ঞানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো মোট পাঁচভাগে বিভক্ত। যথা-
১. ইলমুল আহকাম বা বিধি-বিধান সম্পর্কিত জ্ঞান।
২. ইলমুল মুখাসামা বা বিতর্ক বিদ্যা।
৩. ইলমুত তাযকির বি আলা ইল্লাহ বা আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও নিদর্শন সম্পর্কিত জ্ঞান।
৪. ইলমুত তাযকির বি আইয়ামিল্লাহ বা আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিজগতের অবস্থা, তাঁর প্রদত্ত পুরস্কার ও শাস্তি সংক্রান্ত জ্ঞান।
৫. ইলমুত তাযকির বিল মাউত ওয়ামা বাদাল মাউত বা মৃত্যু ও পরকাল সম্পর্কিত জ্ঞান।
প্রকৃতপক্ষে আল-কুরআন মানবজাতির মহামুক্তির সনদ। এটি মানুষকে আলোর দিকে পরিচালনা করে। শান্তি ও কল্যাণের পথ দেখায়। সুতরাং আমরা আল-কুরআন পড়ব। এর অর্থ জানব এবং তদনুযায়ী আমল করব। আল-কুরআনের জ্ঞান শিক্ষা করে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করব।
কাজ : এ পাঠ পড়ে কুরআন মজিদের শিক্ষা সম্পর্কে শিক্ষার্থী যা জানতে পেরেছে তা তার পাশের বন্ধুকে বলবে। |
কুরআন মজিদ তিলাওয়াতে অনেক সাওয়াব পাওয়া যায়। এটি সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত। এর দ্বারা বান্দা বিরাট সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়। শুধু তিলাওয়াতকারীই নয় বরং তিলাওয়াতকারীর মাতাপিতাও এতে সম্মানিত হন। হাদিসে এসেছে- যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং তদনুযায়ী আমল করে, কিয়ামতের দিন তার পিতামাতাকে মুকুট পরানো হবে। এ মুকুটের ঔজ্জ্বল্য সূর্যের আলোর চেয়েও বেশি হবে। অন্য একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে কুরআন শেখে এবং অপরকেও শিক্ষা দেয়।” (বুখারি)
তিনি আরও বলেছেন, “তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর। কেননা কিয়ামতের দিন তা নিজ পাঠকারীদের জন্য সুপারিশ করবে।” (মুসলিম)
অতএব বোঝা গেল কুরআন তিলাওয়াত অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল। আমরা বেশি বেশি নিয়মিত কুরআন পড়ব এবং অন্যকেও কুরআন পড়তে উৎসাহিত করব।
তাজবিদের গুরুত্ব
সহিহ শুদ্ধভাবে কুরআন পাঠের রীতিকে তাজবিদ বলে। আল-কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত লাভের জন্য সহিহ- শুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে হবে। আর এ জন্য তাজবিদের জ্ঞান অর্জন করা অত্যন্ত প্রয়োজন । তাজবিদ অনুসারে কুরআন তিলাওয়াত করা ওয়াজিব। তাজবিদ অনুসারে কুরআন না পড়লে পাঠকারী গুনাহগার হবে এবং তার নামায শুদ্ধ হবে না । তাজবিদ অনুযায়ী কুরআন পড়া সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
অর্থ : “আপনি ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে কুরআন তিলাওয়াত করুন ।” (সূরা আল-মুয্যাম্মিল, আয়াত ৪ )
একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, “ইলমে কুরআনে পারদর্শী ব্যক্তি ঐসব ফেরেশতার দলভুক্ত, যারা নেককার ও আল্লাহর হুকুমে লেখার কাজে ব্যস্ত । আর যে ব্যক্তি কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও বারবার চেষ্টা করে কুরআন তিলাওয়াত করে, সে দ্বিগুণ সাওয়াব লাভ করবে।” (বুখারি ও মুসলিম)
সুতরাং আমরা নিয়মিত তাজবিদসহ কুরআন তিলাওয়াত করব। যদি কুরআন তিলাওয়াত করতে কষ্ট হয় তবুও পড়তে চেষ্টা করব। কোনো অবস্থাতেই কুরআন তিলাওয়াত ত্যাগ করব না। আর তাজবিদ শিক্ষা করব। এতে আমরা বিরাট সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হতে পারব।
নুন সাকিন : জযমযুক্ত নুনকে নুন সাকিন বলা হয় । অর্থাৎ যে নুনের উপর জযম থাকে তাকে নুন সাকিন বলে।
তানবিন : দুই যবর ( * ), দুই যের ( -) ও দুই পেশকে ) তানবিন বলা হয়৷ তানবিনের মধ্যে একটি জযমযুক্ত নুন উহ্য অবস্থায় থাকে। উচ্চারণের সময় তা প্রকাশ পায়। যেমন- رَجُلٌ - এর উচ্চারণ হবে -এর মতো। অর্থাৎ J (লাম) হরফের তানবিনের বদলে J -এর উপর পেশ ও নুন সাকিন পড়া হয়।
নুন সাকিন ও তানবিনের হুকুম
নুন সাকিন ও তানবিনের উচ্চারণ একই রকম । এজন্য এ দুটির বর্ণনা তাজবিদশাস্ত্রে একসাথে করা হয়। তাজবিদে নুন সাকিন ও তানবিনের হুকুম চারটি। অর্থাৎ চারটি নিয়মে নুন সাকিন ও তানবিনকে পড়তে হয়।
এগুলো হলো-
১. ইদগাম
২. ইখফা
৩. ইযহার
৪. কালব বা ইকলাব
নিম্নে আমরা এগুলো সম্পর্কে জানব।
ইদগাম
ইদগাম শব্দের অর্থ মিলিয়ে পড়া, এক জিনিসকে অন্য জিনিসের সাথে মেলানো। এক হরফকে অন্য হরফের সাথে মিলিয়ে সন্ধি করে পড়া।
তাজবিদের পরিভাষায় নুন সাকিন বা তানবিনের পর ইদগামের ছয়টি হরফ থেকে কোনো একটি হরফ থাকলে নুন সাকিন বা তানবিনের সাথে ঐ হরফকে সন্ধি করে মিলিয়ে পড়াকে ইদগাম বলা হয়।
ইদগামের ফলে উভয় হরফ একই সময়ে উচ্চারিত হয় । ইদগামের ফলে নুন সাকিন বা তানবিনের পরবর্তী হরফটি তাশদিদ যুক্ত হয়। যেমন- ইদগামের হরফ মোট ছয়টি। যথা-
এগুলোকে একত্রে বলা হয়। ইদগাম মোট দুই প্রকার । যথা :
ক. গুন্নাহসহ ইদগাম
খ. গুন্নাহ ছাড়া ইদগাম
ক. গুন্নাহসহ ইদগাম : নুন সাকিন বা তানবিনের পর - -এ - ৬ এই চারটি হরফের যেকোনো একটি আসলে নুন সাকিন বা তানবিনকে ঐ হরফের সাথে মিলিয়ে এক আলিফ পরিমাণ গুন্নাহ করে পড়তে হয়। একে গুন্নাহসহ ইদগাম বলে। এর অপর নাম ইদগামে নাকিস। এখানে ও নুন সাকিন ও তানবিন এর পর ইয়া এবং নুন হরফ আসায় নুন সাকিন ও তানবিনকে ইয়া ও নুন এর সাথে মিলিয়ে এক আলিফ পরিমাণ গুন্নাহ করে পড়তে হয়।
খ. গুন্নাহ ছাড়া ইদগাম : নুন সাকিন বা তানবিনের পর J (রা, লাম) এ দুটি হরফের কোনো - একটি হরফ আসলে নুন সাকিন বা তানবিনকে গুন্নাহ না করে ঐ হরফের সাথে মিলিয়ে পড়তে হয়। একে গুন্নাহ ছাড়া ইদগাম বলে। এর অন্য নাম ইদগামে কামিল। যেমন : مِن لَّدُنْكَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
উপরের উদাহরণ দুটিতে নুন সাকিন ও তানবিনের পরে) (রা) এবং (লাম) হরফ এসেছে । ফলে নুন সাকিন ও তানবিনকে এদের সাথে মিলিয়ে পড়তে হবে। তবে এক্ষেত্রে গুন্নাহ করা যাবে না।
ব্যতিক্রম : ইদগামের নিয়মে আমরা কিছু ব্যতিক্রম দেখতে পাই । যেমন- صِنْوَانٌ بُنْيَانَ - دُنْيَا
এ শব্দসমূহে নুন সাকিনের পর (ইয়া) এবং (ওয়াও) হরফ এসেছে। কিন্তু এখানে ইদগামের নিয়মে নুন সাকিনকে পরবর্তী হরফের সাথে মিলিয়ে তাশদিদসহ পড়া হয় না । এর কারণ ইদগামের উদ্দেশ্য হলো শব্দের উচ্চারণকে সহজ করা। এসব শব্দে মিলিয়ে পড়লে উচ্চারণ কঠিন হয়ে যায়। এজন্য এ শব্দগুলোতে ইদগাম হয় না।
ইখফা
ইখফা অর্থ গোপন করে পড়া । ইখফার হরফ ১৫টি । যথা-
নুন সাকিন বা তানবিনের পর ইখফার হরফ থেকে যেকোনো একটি হরফ এলে উক্ত নুন সাকিন বা তানবিনকে চন্দ্রবিন্দু উচ্চারণ করার মতো নাসিকা সংযোগে গোপন করে এক আলিফ পরিমাণ দীর্ঘ করে পড়াকে ইখফা বলে।
নুন সাকিনের মধ্যে ইখফার উদাহরণ :
তানবিনের মধ্যে ইখফার উদাহরণ :
ইযহার
ইযহার শব্দের অর্থ স্পষ্ট করে পড়া, প্রকাশ করে দেওয়া ইত্যাদি। তাজবিদের পরিভাষায় নুন সাকিন বা তানবিনের পর ইযহারের কোনো একটি হরফ আসলে ঐ নুন সাকিন বা তানবিনকে গুন্নাহ না করে স্পষ্টভাবে নিজ মাখরাজ থেকে পড়াকে ইযহার বলে।
ইযহারের হরফ মোট ছয়টি।
এ হরফগুলোকে হরফে হালকি বলা হয়।
কালব বা ইকলাব
কালব বা ইকলাব অর্থ পরিবর্তন করে পড়া। তাজবিদের পরিভাষায় নুন সাকিন বা তানবিনের পর (বা) হরফ আসলে ঐ নুন সাকিন বা তানবিনকে (মীম) দ্বারা পরিবর্তন করে এক আলিফ পরিমাণ গুন্নাহসহ পড়াকে কালব বা ইকলাব বলে।
ইকলাবের হরফ মাত্র একটি । এটি হলো-(বা)
উল্লেখ্য, কুরআন মজিদে ইকলাবের অবস্থায় নুন সাকিন বা তানবিনের পাশে ছোট করে মীম হরফটি উল্লেখ থাকে।
কাজ : শিক্ষার্থীরা নুন সাকিন ও তানবিনের নিয়ম চারটি লিখে একটি চার্ট তৈরি করবে এবং শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে। |
মীম সাকিন : জযমযুক্ত মীম (?) কে মীম সাকিন বলে । অর্থাৎ মীম হরফের উপর জযম থাকলে তাকে মীম সাকিন বলা হয়।
মীম সাকিন পড়ার নিয়ম তিনটি: যথা-
ক. ইযহার
খ. ইদগাম
গ. ইখফা
ইযহার
ইযহার অর্থ স্পষ্ট করে পড়া। মীম সাকিনের পর ৬ (বা) এবং (মীম) ছাড়া অন্য যে কোনো হরফ আসলে ঐ মীম সাকিনকে স্পষ্ট করে গুন্নাহ ব্যতীত নিজ মাখরাজ থেকে পড়াকে মীম সাকিনের ইযহার বলা হয়। যথা-دِينُكُمْ - اَمَ لَمْ تُنْذِرُهُمْ
ইদগাম
ইদগাম অর্থ মিলিয়ে পড়া। জযমযুক্ত মীম-এর পর হরকত যুক্ত মীম এলে উভয় মীমকে একসাথে মিলিয়ে এক আলিফ পরিমাণ গুন্নাহ করে পড়াকে ইদগাম বলে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় মীমের উপর তাশদিদ যুক্ত হয়। যেমন- فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ
কাজ : মীম সাকিন পড়ার নিয়ম তিনটি শিক্ষার্থী খাতায় লিখে শিক্ষককে দেখাবে। |
নাযিরা তিলাওয়াত হলো দেখে দেখে কুরআন মজিদ তিলাওয়াত করা। নাযিরা তিলাওয়াতের ফজিলত অনেক। কুরআন মজিদ তিলাওয়াতের ফজিলতের বর্ণনা আমরা জেনেছি। অতএব আমরা নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করব এবং এর পূর্ণ ফজিলত লাভ করতে চেষ্টা করব।
কুরআন তিলাওয়াতের আদব
কুরআন মজিদ আল্লাহ তায়ালার বাণী। আল্লাহ তায়ালা যেমন মহান তেমনি তাঁর পবিত্র কালামও মহান। আল্লাহর কালামের মর্যাদা অন্য সব কালামের চেয়ে এত বেশি, যেমন আল্লাহ তায়ালার মর্যাদা সমস্ত সৃষ্টিজগতের চেয়ে বেশি। অতএব, সর্বোচ্চ সম্মান ও আদবের সাথে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে।
পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের কতিপয় আদব নিচে উল্লেখ করা হলো :
ক. পূর্ণরূপে ওযু করে পাক-পবিত্র স্থানে বসা।
খ. কিবলামুখী হয়ে নামাযের অবস্থার মতো বসা।
গ. তিলাওয়াতের আগে কয়েক বার দুরূদ শরিফ পড়া।
ঘ. আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ বলে তিলাওয়াত শুরু করা।
ঙ. হিফয বা মুখস্থ করার নিয়ত না থাকলে ধীরে স্থিরে তাজবিদের সাথে তিলাওয়াত করা।
চ. সক্ষম হলে অর্থ বুঝে তিলাওয়াত করা।
ছ. অর্থ বুঝে না আসলে কুরআন মজিদের প্রতি ভালোভাবে মনোযোগ দেওয়া।
জ. সুন্দর সুরে তিলাওয়াত করা।
ঝ. তিলাওয়াতের সময় কোনোরূপ কথাবার্তা, হাসি-ঠাট্টা না করা।
ঞ. আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের জন্য তিলাওয়াত করা।
ট. তিলাওয়াত শেষে খুব সম্মান ও তাযিমের সাথে কুরআন মজিদকে পবিত্র উঁচুস্থানে রেখে দেওয়া।
আমরা আদবের সাথে নিয়মিত কুরআন পড়ব । পবিত্র কুরআনের প্রতি যেন কোনোরূপ বেয়াদবী না হয় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখব।
নাযিরা তিলাওয়াতের জন্য নির্ধারিত পাঠ-সূরা বাকারার ৯ম রুকু থেকে ১২তম রুকু।
কাজ : শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের সম্মুখে শুদ্ধ উচ্চারণে কুরআন তিলাওয়াত করবে এবং বাড়িতেও শুদ্ধ উচ্চারণে কুরআন তিলাওয়াত করবে। |
সূরা আল-কাদর আল-কুরআনের অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন সূরা। এটি মক্কা নগরীতে অবতীর্ণ হয়। এর আয়াত সংখ্যা পাঁচটি। সূরা আল-কাদর কুরআন মজিদের ৯৭তম সূরা। এ সূরায় ‘লাইলাতুল কাদর'-এর ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। এ সূরায় লাইলাতুল কাদর শব্দটি মোট তিনবার এসেছে । এর কাদর শব্দ থেকে এ সূরার নাম রাখা হয় সূরা আল-কাদর ।
শানে নুযুল
একদা রাসুলুল্লাহ্ (স.) বনি ইসরাইলের এমন একজন লোক সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন, যিনি সমস্ত রাত ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন এবং সারা দিন জিহাদ করতেন। এভাবে এক হাজার মাস যাবৎ অবিরাম আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে মগ্ন থাকেন। এ বিবরণ শুনে সাহাবিগণ বিস্ময় প্রকাশ করলেন। অতঃপর নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে আফসোস করতে লাগলেন।
সাহাবিগণ ভাবলেন— আমরা এক হাজার মাস ইবাদত করার সুযোগ পাব না। অথচ পূর্ববর্তীগণ বহু বছর বেঁচে থাকতেন। বেশি দিন ইবাদত করার সুযোগ পেতেন। ফলে আমরা ইবাদতের সাওয়াবে কোনো দিন তাদের সমান হতে পারব না। সাহাবিগণের আফসোসের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এ সূরা নাজিল করেন। এতে তিনি জানিয়ে দেন যে, লাইলাতুল কাদরের এক রাতের ইবাদত হাজার মাস ইবাদত করার চেয়েও উত্তম।
অনুবাদ
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে ৷
إِنَّا أَنْزَلْنَهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ
১. নিশ্চয়ই আমি এটি (আল-কুরআন) অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রাতে।
وَمَا أَدْرَكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِة
২. আর আপনি কি জানেন এ মহিমান্বিত রাতটি কী?
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنَ الْفِ شَهْة
৩. মহিমান্বিত রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।
تَنَزَّلُ الْمَلَئِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ
8. সে রাতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রুহ (জিবরাইল ফেরেশতা) তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়।
سَلْمٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِةُ
৫. সে রাতের উষা উদয় হওয়া পর্যন্ত শান্তিই শান্তি (বিরাজ করে)।
ব্যাখ্যা
লাইলাতুল কাদর বা কাদরের রাত অত্যন্ত মর্যাদাবান ও মহিমান্বিত রাত। আল্লাহ তায়ালা এ রাতেই পবিত্র কুরআন নাজিল করেন। এ রাতের ইবাদত হাজার মাস একাধারে ইবাদত করার চেয়ে উত্তম। এক হাজার মাস ৮৩ বছর ৪ মাসের সমান। আমাদের আয়ুষ্কাল খুবই সীমিত। এ অবস্থায় এ রাতে ইবাদত করলে আমাদের নেকির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এটি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নিয়ামত স্বরূপ। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাকে রহমত, বরকত ও শান্তির সওগাত দিয়ে প্রেরণ করেন। এ রাতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুখ-শান্তি ও রহমত বিরাজ করতে থাকে।
শিক্ষা : এ সূরা থেকে আমরা নিম্নোক্ত শিক্ষা পাই:
■ লাইলাতুল কাদর অত্যন্ত মহিমান্বিত রাত।
■ এ রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম।
■ এ রাতে ফেরেশতাগণ শান্তি ও কল্যাণ নিয়ে দুনিয়ায় নেমে আসেন।
■ এ রাতে সারাক্ষণ শান্তি ও রহমত বর্ষিত হয়।
আমরা যথাযথভাবে লাইলাতুল কাদর উদযাপন করব। বেশি বেশি নফল ইবাদত বন্দেগি করব। এ রাতের সামান্য সময়ও আমরা ইবাদত না করে কাটাব না। তাহলে আমরা হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা বেশি সাওয়াব লাভ করব। আল্লাহ তায়ালা আমাদের জীবনে শান্তি ও কল্যাণ দান করুন।
কাজ : শিক্ষার্থীরা এ সূরার শানে নুযুল পড়বে এবং তা তাদের খাতায় লিখে শিক্ষককে দেখাবে। |
আল-কুরআনের ৯৯তম সূরা আল-যিলযাল। এ সূরায় কিয়ামতের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত যিলযাল শব্দ থেকে এর নাম রাখা হয়েছে সূরা আল-যিলযাল। এটি মদিনা নগরীতে অবতীর্ণ হয়। এর আয়াত সংখ্যা আটটি।
শানে নুযুল
একদা জনৈক ব্যক্তি একজন ফকিরকে অতি অল্প পরিমাণ খাদ্য দান করে । অতঃপর সে বলল যে, এ সামান্য দানে কি সাওয়াব হবে? অপর এক ব্যক্তি ছোট ছোট গুনাহ করত। এগুলো থেকে বিরত থাকত না। বরং সে এগুলোকে অবহেলা করত। আর এগুলোর কোনো গুরুত্ব দিত না।
এ দুই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এ সূরা নাজিল করেন । আর সকলকে জানিয়ে দেন যে, পুণ্য বা পাপ তা যত ছোটই হোক না কেন কিয়ামতে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। অতঃপর এগুলোর জন্য ও পুরস্কার বা শাস্তি ভোগ করতে হবে।
অনুবাদ
بِسْمِ اللهِ الرَّحمنِ الرَّحِيمِ
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে।
إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا
১. যখন পৃথিবী আপন কম্পনে প্রবলভাবে প্রকম্পিত হবে।
وَاخْرَجَتِ الْأَرْضُ الْقَالَهَا
২. আর পৃথিবী যখন তার (অভ্যন্তরস্থ) ভারসমূহ বের করে দেবে।
وَقَالَ الْإِنْسَانُ مَا لَهَا
৩. এবং মানুষ বলতে থাকবে এর (পৃথিবীর) কী হলো?
يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا
৪. সেদিন পৃথিবী তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে।
بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَى لَهَا
৫. কেননা আপনার প্রতিপালক তাকে (এজন্য) আদেশ করবেন।
يَوْمَئِذٍ يَصْدُرُ النَّاسُ أَشْتَانَاهُ لِيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ
৬. সেদিন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দলে বের হবে, যাতে তাদেরকে তাদের আমলসমূহ দেখানো যায়।
فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَّرَةَ
৭. কেউ অণু পরিমাণ সৎকাজ করলে তা সে দেখবে।
وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُهُ
৮. আর কেউ অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করলে, তাও সে দেখতে পাবে।
ব্যাখ্যা
এ সূরায় কিয়ামত বা মহাপ্রলয়ের বর্ণনা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এক সময় গোটা দুনিয়া ধ্বংস করে দেবেন। তিনি হযরত ইসরাফিল (আ.)-কে শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়ার আদেশ দেবেন। হযরত ইসরাফিল (আ.)-তখন শিঙ্গায় ফুঁক দেবেন । তাঁর শিঙ্গার শব্দে সারা পৃথিবীর সমস্ত নিয়ম- শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যাবে। পৃথিবী চরমভাবে কাঁপতে থাকবে। পৃথিবীর দালানকোঠা, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা সমস্ত কিছুই সেদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আসমান ভেঙ্গে যাবে। ভূপৃষ্ঠ তার ভেতরের সবকিছু বের করে দেবে । কবরসমূহ থেকে মানুষ বের হয়ে আসবে। এসব কিছু দেখে মানুষ আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাবে। এরপর সকল মানুষ হাশরের ময়দানে একত্র হবে । সেখানে তাদের দুনিয়ার কাজকর্মের হিসাব নেওয়া হবে। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র কাজকর্মও সেদিন হিসাবের বাইরে থাকবে না। বরং ছোট পাপ করলেও তার শাস্তি পেতে হবে। অন্যদিকে অণু পরিমাণ পুণ্য করলেও সেদিন মানুষ তার আমলনামায় দেখতে পাবে। এ পরিমাণ পুণ্যেরও প্রতিদান দেওয়া হবে।
শিক্ষা : এ সূরার শিক্ষা নিম্নরূপ:
কিয়ামতে পৃথিবীর অবস্থা হবে ভয়াবহ। সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।
মানুষ মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হবে।
হাশরের ময়দানে মানুষ নিজ নিজ আমলনামা দেখতে পাবে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাপ বা পুণ্য কোনো কিছুই এ আমলনামায় বাদ পড়বে না।
আমরা সর্বদা কিয়ামত, হাশর ও আখিরাতের কথা স্মরণ রাখব। সেখানে আল্লাহর সামনে আমাদের দাঁড়াতে হবে।
কাজ : শিক্ষার্থী সূরা যিলযালের চারটি শিক্ষা তার পাশের সহপাঠীকে বলবে এবং তা খাতায় লিখবে। |
সূরা ফিল আল-কুরআনের ১০৫তম সূরা। এটি মক্কা নগরীতে অবতীর্ণ হয় । এর আয়াত সংখ্যা পাঁচটি। ফিল অর্থ হাতি। এ সূরায় হস্তিবাহিনীর করুণ পরিণতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে বিধায় এ সূরার নাম রাখা হয়েছে সূরা ফিল।
শানে নুযুল
আরবের ইয়ামান প্রদেশের শাসনকর্তার নাম ছিল আবরাহা। সে ছিল খ্রিষ্টান। সে সানআ নামক স্থানে একটি সুন্দর ও বহু মণিমুক্তা খচিত গির্জা তৈরি করে । অতঃপর মানুষকে তার গির্জায় উপাসনার জন্য আহ্বান করে। সে চাইল মানুষ যেন মক্কা শরিফে অবস্থিত পবিত্র কাবাগৃহ ছেড়ে তার গির্জায় উপাসনার জন্য আগমন করে। কিন্তু মানুষ কাবাগৃহকে খুব সম্মান করত। সুতরাং তারা তার আহ্বানে সাড়া দিল না । তারা আগের মতোই কাবাগৃহে উপাসনা করতে লাগল। এতে আবরাহা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। সে চিন্তা করল- কাবাগৃহ ধ্বংস না করলে তার উদ্দেশ্য সফল হবে না। এ জন্য সে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে কাবাগৃহ ধ্বংসের জন্য মক্কা নগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সে বহু সৈন্য সংগ্রহ করে এবং ১৩টি বিশালকায় শক্তিশালী হাতি নিয়ে অগ্রসর হয়। আবরাহার আক্রমণের সংবাদ পেয়ে আব্দুল মুত্তালিব কুরাইশদের পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বললেন। আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দাদা ও কুরাইশদের সর্দার। তিনি জানতেন যে কাবা হলো আল্লাহর ঘর। সুতরাং এ ঘরের রক্ষার দায়িত্বও আল্লাহরই উপর । আব্দুল মুত্তালিবের নির্দেশে কুরাইশগণ পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নিল। পরদিন ভোরে আবরাহা তার বাহিনী নিয়ে কাবা অভিমুখে রওয়ানা হলো। এমন সময় আল্লাহ তায়ালা সমুদ্রের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করলেন। এগুলো ছিল একপ্রকার ছোট পাখি। এরা দুই পায়ে দুটি এবং ঠোঁটে একটি করে কংকর নিয়ে এলো। অতঃপর এগুলো আবরাহার বাহিনীর উপর নিক্ষেপ করল। ফলে আবরাহার সৈন্যবাহিনী ধ্বংস হয়ে গেল। আর আবরাহা আহত অবস্থায় পালিয়ে গেল। পরে তার ক্ষতস্থানে পচন ধরে এবং ভয়ঙ্কর কষ্টের পর সে মারা যায় । এভাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর ঘরকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন।
হস্তিবাহিনীর ঘটনাটি ৫৭০ সালে সংঘটিত হয়। আমাদের প্রিয়নবি (স.) এ বছরই জন্মগ্রহণ করেন। এ অলৌকিক ঘটনা তাঁর জন্মের ৫০দিন পূর্বে ঘটেছিল। আল্লাহ তায়ালা এ সূরা নাজিল করে এ বিশেষ ঘটনা সকলকে জানিয়ে দেন।
অনুবাদ
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে।
الم ترَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِاصْبِ الْفِيْلِ
১. আপনি কি দেখেন নি, আপনার প্রতিপালক হস্তি বাহিনীর প্রতি কিরূপ আচরণ করেছিলেন?
الَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ
২. তিনি কি তাদের কৌশল ব্যর্থ করে দেন নি?
وَارْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ
৩. আর তিনি তাদের প্রতি ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেন।
تَرْمِيهِمُ بِحِجَارَةٍ مِّنْ سِجيل
8. সেগুলো তাদের উপর কংকর জাতীয় পাথর নিক্ষেপ করে।
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّا كُولٍ
৫. অতঃপর তিনি তাদের ভক্ষিত তৃণসদৃশ করেন।
ব্যাখ্যা
ইয়ামানের বাদশাহ আবরাহা ছিল অনেক ধন-সম্পদ ও সৈন্য-সামন্তের অধিকারী। তার ছিল বিশাল হস্তিবাহিনী। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কুদরতের তুলনায় এসব ধন-সম্পদ, ক্ষমতা কিছুই না। বরং আল্লাহ তায়ালা যা চান তাই হয়। তিনি যাকে যেভাবে ইচ্ছা লাঞ্ছিত, অপমানিত করতে পারেন।
আবরাহা গর্ব ও অহংকারবশত আল্লাহ তায়ালার সাথে শত্রুতা করে। ফলে সে ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা ছোট ছোট পাখির সাহায্যে তার বিশাল বাহিনী ধ্বংস করে দেন। বস্তুত এটা ছিল আল্লাহর কুদরত মাত্র। আল্লাহর সাথে শত্রুতা ও বিরোধিতাকারীদের তিনি এভাবেই ধ্বংস করে থাকেন।
শিক্ষা : এ সূরার শিক্ষা নিম্নরূপ :
■ আল্লাহদ্রোহীদের আল্লাহ তায়ালা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেন।
■ তিনি তাদের সমস্ত কলাকৌশল ব্যর্থ করে দেন।
আমরা আল্লাহ তায়ালার অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে বিশ্বাস রাখব। তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলব। তাঁর দীনের সাথে কখনো শত্রুতা করব না।
কাজ : সূরা ফিল নাজিল হওয়ার পটভূমি সম্পর্কে শিক্ষার্থী বন্ধুকে বলবে এবং এ সূরার শিক্ষা নিয়ে তার সাথে আলোচনা করবে। |
সূরা কুরাইশ হলো মক্কি সূরা। এর আয়াত সংখ্যা চারটি। এটি আল-কুরআনের ১০৬তম সূরা। এ সূরায় মক্কা নগরীর কুরাইশদের কথা বর্ণনা করা হয়েছে । এজন্য এর নাম রাখা হয়েছে সূরা কুরাইশ ।
শানে নুযুল
পবিত্র কাবাগৃহ মক্কা নগরীতে অবস্থিত। এ গৃহের রক্ষণাবেক্ষণ ও সেবার দায়িত্ব ছিল কুরাইশ সম্প্রদায়ের উপর। এজন্য কুরাইশগণ বহু সুযোগ সুবিধা লাভ করত। লোকজন তাদের সম্মান করত। তাদের নেতৃত্ব মেনে চলত। তাদের প্রতি কোনোরূপ অন্যায়-অত্যাচার করার সাহস পেত না। এ সুযোগে তারা সিরিয়া, ইয়ামান প্রভৃতি দেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য করত। চোর-ডাকাত, ছিনতাইকারীরা তাদের বাধা দিত না। এমনকি শীত-গ্রীষ্মের প্রতিকূল পরিবেশেও তারা সকলের সহযোগিতায় নির্বিঘ্নে ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে পারত। তাছাড়া হজ উপলক্ষে বিপুল লোকজন মক্কা নগরীতে আসত, এতে কুরাইশগণ বহু অর্থ-সম্পদ লাভ করত। কুরাইশদের এসব মানসম্মান ও ধন-সম্পদ ছিল মূলত কাবা গৃহের বদৌলতে। সুতরাং তাদের উচিত ছিল এ গৃহের প্রভুকে মেনে চলা। অথচ তারা তা করত না। বরং তারা ছিল মুশরিক । তারা মূর্তিপূজা করত। আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করত না। রিসালাত ও আখিরাতেও তারা বিশ্বাস করত না। এমনকি রাসুলুল্লাহ (স.) যখন ইসলামের দাওয়াত শুরু করলেন তখনো তারা তাঁর বিরোধিতা করতে লাগল। এ জঘন্য ও অনৈতিক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এ সূরা নাজিল করে তাদের সতর্ক করে দেন।
অনুবাদ
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে।
لا يُلفِ قريش
১. যেহেতু কুরাইশের আসক্তি রয়েছে।
الفِهِمْ رِحْلةَ الشَّتَاءِ وَالصَّيْفِ
২. আসক্তি রয়েছে তাদের শীত ও গ্রীষ্মে সফরের।
فَلْيَعْبُدُوا رَبَّ هَذَا الْبَيِّت
৩. অতএব, তারা এ ঘরের মালিকের ইবাদত করুক।
الَّذِي أَطْعَمَهُم مِّنْ جُوعٍ، وَأَمَنَهُمْ مِنْ خَوْفٍ
৪ . যিনি তাদের ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন আর তাদের নিরাপদ করেছেন ভয়-ভীতি থেকে।
ব্যাখ্যা
এ সূরায় কুরাইশদের নানা নিয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অতঃপর এসব নিয়ামতের পরিবর্তে তাদের কী করা উচিত এ সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
মক্কা নগরীতে কাবা গৃহ অবস্থিত। কাবা হলো আল্লাহর ঘর। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা মক্কার কুরাইশদের নানা সুবিধা প্রদান করেন। তিনি তাদের সম্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তা দান করেন। ক্ষুধা তৃষ্ণায় খাদ্য, পানীয় দান করেন । সুতরাং তাদের কর্তব্য হলো এসব নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। যে ঘরের বদৌলতে তারা এসব লাভ করলো সে ঘরের মালিকের ইবাদত করা । কেননা তিনিই তাদের এসব দান করেছেন।
শিক্ষা : এ সূরার শিক্ষা নিম্নরূপ:
■ আল্লাহ তায়ালা আমাদের খাদ্য-পানীয় ও নিরাপত্তা দান করেন।
■ তিনি সকল নিয়ামতের মালিক।
■ সকলেরই উচিত তাঁর ইবাদত করা।
অতএব, আমরা সবসময় আল্লাহর ইবাদত করব। তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের জন্য তাঁর শুকরিয়া আদায় করব। তাহলে তিনি আমাদের প্রতি নিয়ামত আরও বাড়িয়ে দেবেন।
কাজ : সূরা কুরাইশের তিনটি শিক্ষা শিক্ষার্থীরা খাতায় লিখবে ও শিক্ষককে দেখাবে। |
সূরা আন-নাস্ত্র পবিত্র কুরআনের একটি সূরা। এই সূরা মক্কায় বিদায় হজের সময় অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু যে সমস্ত সূরা হিজরতের পরে অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলো স্থান নির্বিশেষে মাদানি সূরা। এজন্য এ সূরাও মাদানি সূরা। এর আয়াত সংখ্যা তিন। সূরা আন-নাস্র পবিত্র কুরআনের ১১০তম সূরা। এ সূরার ‘নাস্’ শব্দ থেকে সূরাটির নাম রাখা হয়েছে আন-নাস্।
অনুবাদ
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে৷
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ .
১. যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়।
وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا
২ . এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেখবেন।
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرُهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا
৩. তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন, তিনি তো তওবাকবুলকারী।
ব্যাখ্যা
হাদিসে বর্ণিত আছে যে, সূরা আন-নাস্ত্র কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা। অর্থাৎ এরপর কোনো সম্পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ হয় নি। এ সূরাতে মক্কা বিজয়ের পর মানুষ যে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তা উল্লেখ করা হয়েছে । ইসলামের এ বিজয়ের ফলে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নবুয়তী দায়িত্বের পরিপূর্ণতাও বোঝানো হয়েছে। তাই বিশিষ্ট সাহাবিগণ এ সূরা নাজিল হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ওফাত নিকটবর্তী বলে বুঝতে পেরেছিলেন । মহানবি (স.)-এর দুনিয়াতে আগমন ও অবস্থান করার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে বলে এ সূরায় ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ সূরা দ্বারা আরও বোঝানো হয়েছে যে, কোনো ব্যাপারে যখন আল্লাহ সাহায্য করেন তখন অনেক অসাধ্য কাজও সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। তখন আল্লাহর প্রশংসা করা আবশ্যক।
শিক্ষা : এ সূরার শিক্ষা নিম্নরূপ :
■ আমাদের যাবতীয় কাজে আল্লাহর সাহায্য প্রয়োজন।
■ আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সফলতা লাভ করা যায় না।
■ কোনো কাজে সফলতা আসলে আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করা উচিত।
■ যাবতীয় ত্রুটি, অপরাধ বা পাপকাজের জন্য তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।
অতএব, সকল সাওয়াবের কাজ করতে ও পাপকাজ থেকে বাঁচতে আমরা আল্লাহর সাহায্য চাইব। যখন আমাদের সফলতা আসবে তখন আমরা আল্লাহর প্রশংসা করব। আর যদি কোনো ত্রুটি হয়ে যায়, এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব।
কাজ : শিক্ষার্থীরা সূরা আন-নাসরের চারটি শিক্ষা খাতায় লিখে শিক্ষককে দেখাবে। |
আলোচ্য আয়াতটি পবিত্র কুরআনের সূরা আল-বাকারার ২৫৫নং আয়াত। এটি আল-কুরআনের সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ আয়াত।
কুরসি শব্দের অর্থ একবস্তুর সাথে অন্য বস্তুর মিলানো। এ জন্য চেয়ার বা আসনকে কুরসি বলা হয়। কেননা আসনে অনেক কাঠকে একত্র করা হয়। কুরসি শব্দের অন্য অর্থ হলো সাম্রাজ্য, মহিমা, জ্ঞান ও সিংহাসন। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালার পরিচয়, ক্ষমতা, মহিমা ও গৌরবের কথা অত্যন্ত স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ জন্য এ আয়াতকে আয়াতুল কুরসি বলা হয়।
ফজিলত
আয়াতুল কুরসি অত্যন্ত বরকতময় আয়াত। রাসুলুল্লাহ (স.) এ আয়াতকে সবচেয়ে উত্তম আয়াত বলে অভিহিত করেছেন। মহানবি (স.) বলেছেন- 'যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর আয়াতুল কুরসি নিয়মিত পাঠ করে, তার জন্য বেহেশতে প্রবেশের পথে একমাত্র মৃত্যু ব্যতীত আর কোনো বাধা থাকে না।' (নাসাই)
অর্থাৎ মৃত্যুর সাথে সাথেই সে বেহেশতের আরাম-আয়েশ উপভোগ করতে শুরু করবে।
অন্য হাদিসে মহানবি (স.) বলেন, যে ব্যক্তি প্রভাতে ও শয়নকালে আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে সর্বপ্রকার বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবেন । (তিরমিযি)
অপর এক হাদিসে এসেছে, একদা, 'রাসুল (স.) উবাই ইবনে কা'বকে জিজ্ঞাসা করলেন- কুরআনের কোন আয়াতটি সবচাইতে শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ । উবাই (রা.) বললেন, তা হলো আয়াতুল কুরসি । উত্তর শুনে রাসুল (স.) তা সমর্থন করলেন এবং বললেন- হে আবুল মুনযির [উবাই (রা.)-এর ডাকনাম] এ উত্তম জ্ঞানের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।' (সহিহ্ মুসলিম)
অনুবাদ
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে।
اللهُ لا إلهَ إِلَّا هُوَ
আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই।
তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী।
لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمُ
তন্দ্রা বা নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করে না।
لهُ مَا فِي السَّمَواتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ
আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে সমস্ত তাঁরই।
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَةٌ إِلَّا بِإِذْنِهِ
কে আছে এমন, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করবে?
يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ
তাদের সামনে ও পেছনে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন।
وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ
তিনি যা ইচ্ছা করেন, তা ছাড়া তাঁর জ্ঞানের কোনো কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারে না।
وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَوتِ وَالْأَرْضَ
তাঁর কুরসি আসমান ও পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত।
وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا
আর এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না।
وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ
আর তিনি অতি মহান, সর্বশ্রেষ্ঠ।
তাৎপর্য
এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় অতি সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে । আল্লাহ তায়ালার গুণাবলি ও ক্ষমতা এ আয়াতে স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে।
আয়াতের প্রথমেই বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র ইলাহ, তিনি ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। সকল ইবাদত ও প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য নির্ধারিত। তিনি অনাদি অনন্ত। তিনি চিরকাল ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন । তাঁর জ্ঞান অসীম, সকল কিছুই তাঁর জ্ঞানের আওতাধীন। তিনি মহান সত্তা। আসমান জমিনের বিশালতা তাঁর কাছে কিছুই না। তিনি ক্লান্তি, নিদ্রা, তন্দ্রা ইত্যাদির ঊর্ধ্বে । এককথায় তিনিই সর্বশক্তিমান, সকল শক্তির আধার, মহান, সর্বশ্রেষ্ঠ।
কাজ : আয়াতুল কুরসি পাঠের ফজিলত একটি কাগজে লিখে তা শিক্ষার্থী পড়ার টেবিলের সামনে ঝুলিয়ে রাখবে। |
সূরা হাশর পবিত্র কুরআনের ৫৯তম সূরা। সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত অর্থাৎ ২২, ২৩ এবং ২৪তম আয়াত নিয়ে অর্থসহ উল্লেখ করা হয়েছে।
ফজিলত : এ তিন আয়াতের ফজিলত অত্যন্ত বেশি । রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- যে ব্যক্তি সকালে তিনবার
(উচ্চারণ : আউযু বিল্লাহিস সামিইল আলিমি মিনাশ শাইতানির রাজিম ।) পাঠ করার পর সূরা হাশরের শেষ আয়াত তিনটি তিলাওয়াত করবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা নিয়োগ করে দেবেন। তাঁরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য রহমতের দোয়া করতে থাকবে। সেদিন সে মারা গেলে শহিদের মৃত্যু লাভ করবে। আর সন্ধ্যাকালে যে ব্যক্তি এভাবে পাঠ করবে সেও এ ফজিলত লাভ করবে। (তিরমিযি)
অনুবাদ
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ .
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে।
১. علمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ - তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা।
هُوَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمُ - তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু।
২. هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ - তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই।
الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَمُ - তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি
الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ - তিনিই নিরাপত্তা দানকারী, তিনিই রক্ষক,
الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَثِرُ - তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অতীব মহিমান্বিত।
سُبْطنَ اللهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ - তারা যা কিছু শরিক স্থির করে, আল্লাহ তা থেকে পবিত্ৰ, মহান।
৩. هُوَ اللهُ الْخَالِقُ _ তিনিই আল্লাহ, সৃষ্টিকর্তা।
الْبَارِةُ الْمُصَورُ - উদ্ভাবনকর্তা, রূপদাতা।
يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ - আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।
وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ - তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
ব্যাখ্যা
এ আয়াতসমূহ আল্লাহ তায়ালার গুণবাচক নামে পরিপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালার এসব গুণবাচক নাম তাঁর ক্ষমতা ও পরিচয়ের স্বরূপ প্রকাশ করে। তিনি সর্বশক্তিমান। আসমান জমিন সবকিছুর মালিক। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই হয় । তিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই। তিনিই একমাত্র ইলাহ বা মাবুদ। আসমান ও জমিনের সবই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। সুতরাং মানুষের উচিত একমাত্র তাঁরই দাসত্ব করা। সর্বাবস্থায় তাঁরই ইবাদত বন্দেগি করা।
কাজ : শিক্ষার্থীরা সূরা হাশরের শেষের আয়াত তিনটি মুখস্থ করে অর্থসহ খাতায় লিখে শিক্ষককে দেখাবে। |
আল-কুরআন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। এটি জ্ঞান বিজ্ঞানের মূল উৎস। নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও এ কিতাব বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কুরআন মজিদ হলো নৈতিকতার আধার। নীতি- নৈতিকতার সকল দিকই এ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে নানাভাবে নৈতিকতার শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে। এ পাঠে আমরা নৈতিক শিক্ষা প্রদানে আল-কুরআনের নানা দিকের কথা জানব।
আল-কুরআন আল্লাহ তায়ালার বাণী। এতে আল্লাহ তায়ালার পরিচয়ও বর্ণনা রয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তায়ালার নানা গুণের পরিচয় পাই। যেমন- তিনি করুণাময়, অসীম দয়ালু, ক্ষমাশীল, ন্যায়পরায়ণ । মহান আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়া আমাদের কর্তব্য।
আল-কুরআন থেকে আমরা এসব গুণের পরিচয় লাভ করব। এরপর আমরা এগুলোর চর্চা করব। ফলে নীতি-নৈতিকতার দ্বারা আমরা আমাদের চরিত্র সুন্দর করতে পারব।
দুনিয়াতে আগমনকারী নবি-রাসুলগণের বর্ণনা রয়েছে আল-কুরআনে। এতে তাঁদের পরিচয়, তাঁদের স্বভাব-চরিত্র ইত্যাদির বিবরণ দেওয়া হয়েছে। নবি-রাসুলগণের সফলতা, কৃতিত্বের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা ছিলেন নিষ্পাপ। নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি তাঁদের চরিত্রের ভূষণ ছিল । তাঁরা ছিলেন মানবজাতির জন্য আদর্শ। আর যারা তাঁদের অনুসরণ করেছে তারাই সফলতা লাভ করেছে। আর আল-কুরআনের শিক্ষার দ্বারাই আমরা তাঁদের অনুসরণ করতে পারি।
আমাদের প্রিয়নবি (স.) ছিলেন নবি-রাসুলগণের সর্দার। তিনি ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী । সকল গুণের পরিপূর্ণ সমন্বয় তাঁর চরিত্রে ঘটেছিল । আল-কুরআনে বলা হয়েছে-
অর্থ : “নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ (স.)-এর চরিত্রে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে।” (সূরা আল-আহযাব : ২১)
মহানবি (স.)-এর চরিত্র ও নৈতিকতার কথা কুরআন মজিদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। একবার উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন-
অর্থ : “আল-কুরআনই তো তাঁর (রাসুলের) চরিত্র।”
অর্থাৎ আল-কুরআনের সমস্ত শিক্ষা ও নৈতিকতাই তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। এসব শিক্ষা অনুশীলন করে আমরাও প্রিয়নবি (স.) এর উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতার অনুকরণ করতে পারি।
কুরআন মজিদে পূর্ববর্তী বহু জাতি ও মানুষের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যারা তাদের পাপ ও অনৈতিক কাজের জন্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তাদের সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যেমন- আদ জাতি, ছামুদ জাতি, ফিরআউন, নমরুদ, কারুন ইত্যাদি। এসব জাতি ও ব্যক্তিদের বর্ণনা আমাদের অনৈতিকতা থেকে বেঁচে থাকার শিক্ষা দেয়। অতএব, তারা যেসব অনৈতিক কাজ করত তা থেকে আমরা বিরত থাকব। আর সর্বাবস্থায় নৈতিকতার অনুশীলন করব।
নৈতিক জীবনযাপনের জন্য অনেক নির্দেশনা আল-কুরআনে দেওয়া হয়েছে। এগুলো আমাদের নৈতিক জীবনযাপনে উৎসাহিত করে। নিচে নীতিমূলক কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো:
অর্থ : “সে-ই সফলকাম হবে যে নিজেকে পবিত্র করবে। আর যে নিজেকে কলুষিত করবে সেই ব্যর্থ হবে ।” (সূরা আশ্-শামস, আয়াত ৯-১০)
অর্থ : “নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৫৩)
অর্থ : “নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচারের নির্দেশ প্রদান করেন।” (সূরা আন-নাহল, আয়াত ৯০)
অর্থ : “আর ক্ষমা করে দেওয়াই তাকওয়ার অধিকতর নিকটবর্তী ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৩৭)
অর্থ : “আর তোমরা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে, নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে (কিয়ামতে) জিজ্ঞাসা করা হবে ।” (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৪)
এভাবে আল-কুরআনের বহু আয়াতে নৈতিক গুণাবলি অনুশীলনের জন্য আদেশ ও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে । পাশাপাশি অনৈতিক ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে। আমরা অনৈতিকতা থেকে বিরত থাকার জন্য নিষেধমূলক কয়েকটি আয়াত নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
অর্থ : “তোমরা খাও ও পান কর । তবে অপচয় করো না । নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ তায়ালা) অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।” (সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত ৩১)
অর্থ :“ অহংকারবশত তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না । নিশ্চয় আল্লাহ কোনো উদ্ধত, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা লুকমান, আয়াত ১৮)
অর্থ : “আর তোমরা একে অপরের পেছনে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই কর ।” (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১২)
এছাড়া আরও অনেক আয়াতের দ্বারা মানবজাতিকে নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে । আমরা এসব শিক্ষা জানব এবং নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করব । ফলে আমাদের চরিত্র সুন্দর হবে । আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করব।
কাজ : খ. শিক্ষার্থীরা নীতিমূলক আয়াত পাঁচটি কাগজে লিখে নিজ নিজ পড়ার টেবিলের সামনে ঝুলিয়ে রাখবে। |
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন মানবতার মহান শিক্ষক। তিনি সর্বদাই মানুষের কল্যাণ কামনা করতেন। কিসে মানুষের ভালো হবে, কী কাজ করলে মানুষ সফলতা লাভ করবে, তা দেখিয়ে দিতেন। দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভের নানা পন্থা তিনি আমাদের দেখিয়ে গেছেন। এর একটি হলো মোনাজাত। তিনি জানতেন আল্লাহ তায়ালার নিকট মোনাজাত করার মাধ্যমে আমরা সার্বিক কল্যাণ লাভ করতে পারি। এজন্য তিনি আমাদের বহু মোনাজাত শিক্ষা দিয়েছেন। হাদিসের কিতাবসমূহে মোনাজাতমূলক বহু হাদিস আমরা দেখতে পাই। এ পাঠে আমরা মোনাজাতমূলক তিনটি হাদিস শিখব।
হাদিস-১
অর্থ : “হে আল্লাহ! হে অন্তরসমূহ ফিরানোর মালিক! তুমি আমাদের অন্তরসমূহকে তোমার আনুগত্যের দিকে ফিরিয়ে দাও ।” (সহিহ্ মুসলিম)
হাদিস-২
অর্থ : “হে আল্লাহ! তুমি আমার অন্তরকে মুনাফিকি থেকে, আমার আমলকে রিয়া থেকে, আমার চোখকে খিয়ানত থেকে, আর আমার জিহবাকে মিথ্যা থেকে পবিত্র কর। কেননা চোখের অপব্যবহার ও অন্তরে যা গোপন আছে সে সম্পর্কে তুমি অবশ্যই অবগত।” (বায়হাকি)
হাদিস-৩
অর্থ : “হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট সুস্থতা, পবিত্রতা, উত্তম চরিত্র এবং তাকদিরের উপর সন্তুষ্ট থাকার মন মানসিকতা কামনা করি।” (বায়হাকি)
উপরোক্ত মোনাজাতমূলক হাদিসগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো চর্চার মাধ্যমে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ লাভ করতে পারি। অতএব, আমরা অর্থসহ এ মোনাজাতগুলো শিখব। এরপর এগুলোর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নিকট মোনাজাত করব। তাহলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের সর্বোত্তম সফলতা দান করবেন।
কাজ : শিক্ষার্থীরা মোনাজাতমূলক হাদিস তিনটি অর্থসহ মুখস্থ করবে এবং এগুলো দ্বারা নিয়মিত আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করবে। |
মানুষের জীবন ও সমাজকে সুন্দর করতে হলে নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ চরিত্রের অনুসরণ অপরিহার্য। উত্তম চরিত্র, নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ ব্যতীত কোন ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির উন্নতি হতে পারে না। আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন উন্নত ও মহান চরিত্রের অধিকারী । নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের জন্য তিনি সকলের নিকট প্রশংসিত ছিলেন । তাঁর নীতি-নৈতিকতা এবং আদর্শ চরিত্রের বিবরণ হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে।
উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতা শিক্ষা দানের জন্য মহানবি (স.)-এর আবির্ভাব । মহানবি (স.) বলেছেন-
অর্থ : “উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা দানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।” (বায়হাকি)
পবিত্র কুরআনে নৈতিকতা অর্জন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আছে। মহানবি (স.)- এর হাদিসেও নৈতিকতা অর্জন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কী কী নৈতিক গুণ অর্জন করলে মানবজীবন সুন্দর ও সফল হবে মহানবি (স.)-এর পবিত্র হাদিসে এ সম্পর্কে যেমন তার বিবরণ রয়েছে তেমনি অনৈতিক কার্যাবলি বর্জনেরও জোর তাগিদ রয়েছে।
সততা, সত্যবাদিতা, শালীনতাবোধ, সৃষ্টির সেবা, আমানত রক্ষা, ক্ষমা, দয়া, পরোপকারিতা, ধৈর্য, ভ্রাতৃত্ববোধ, সমাজসেবা, দেশপ্রেম, পরমতসহিষ্ণুতা, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি কর্তব্য এবং শিক্ষক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা, ছোটদের প্রতি স্নেহ, সহপাঠীদের প্রতি সুন্দর আচরণ ইত্যাদি নৈতিক গুণের বিবরণ হাদিস শরিফে রয়েছে। মহানবি (স.) নিজ জীবনে এসব নৈতিক গুণ বাস্তবায়ন করে নিজেকে বিশ্ব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নীতিবান ও আদর্শ মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
অন্যদিকে তিনি মহানবি (স.) অনৈতিক আচার আচরণ যেমন- মিথ্যাচার, পরনিন্দা, গালি দেওয়া, হিংসা, ক্রোধ, লোভ, প্রতারণা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা, অহংকার, অশ্লীলতা, পরশ্রীকাতরতা, ঘৃণা, চৌর্যবৃত্তি সন্ত্রাস ইত্যাদি বর্জন করার জোর তাগিদ দিয়েছেন এবং এসবের কুফল ও ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে তিনি তাঁর হাদিসে মূল্যবান দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
নৈতিকতা ও অনৈতিকতা সম্পর্কিত কয়েকটি হাদিস নিম্নে বর্ণিত হলো-
দয়া-মায়া ও সৃষ্টির সেবা সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেছেন-
অর্থ: “তোমরা জমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো, তাহলে আসমানের অধিপতি মহান আল্লাহ তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।” (তিরমিযি)
মহানবি (স.) আরও বলেন-
অর্থ : “সমগ্র সৃষ্টিজগৎ আল্লাহর পরিবার। আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই প্রিয়, যে তার পরিবারের প্রতি অনুগ্রহ করে।” (বায়হাকি)
শালীনতা সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেন-
অর্থ : “নিঃসন্দেহে আল্লাহ অশালীন ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন।” (তিরমিযি)
আমানত সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেন,
অর্থ : “যার আমানতদারি নেই তার ইমানও নেই ।” (মুসনাদে আহমাদ)
শ্রমিকের পারিশ্রমিক দ্রুত আদায়ের তাগিদ দিয়ে মহানবি (স.) বলেন,
অর্থ : “শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার পূর্বে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।” (ইবনে মাজাহ)
মহানবি (স.) এভাবে অসংখ্য হাদিসের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষাকে যেমন জগতবাসীর নিকট তুলে ধরেছেন তেমনি অনৈতিকতা ও অসচ্চরিত্র থেকেও বেঁচে থাকতে মানব জাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন।
তাঁর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
অর্থ : “সেই ব্যক্তি প্রকৃত মুসলমান, যার জিহবা ও হাত থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে ।” (বুখারি ও মুসলিম)
মহানবি (স.) বলেন-
অর্থ : “তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কারণ, আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়, হিংসা তেমনি পুণ্যকে ধ্বংস করে দেয় ।” (আবু দাউদ)
মহানবি (স.) বলেন-
অর্থ : “যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়।” (মুসলিম)
মহানবি (স.) বলেন, “মহান আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সকল পাপই ক্ষমা করে দেন । কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতার পাপ তিনি ক্ষমা করেন না।” (বায়হাকি)
মহানবি (স.)-এর পবিত্র হাদিস আমরা অধ্যয়ন করে নৈতিকতা ও সচ্চরিত্র সম্পর্কে জানব এবং আমাদের জীবনে তা বাস্তবায়ন করব। আবার অনৈতিক কাজ ও অসচ্চরিত্রের দিকগুলো সম্পর্কে মহানবি (স.)-এর হাদিস জানব। এসবের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানব এবং সেসব বর্জন করে চলব। এতে আমাদের জীবন সুন্দর হবে । সবাই আমাদের ভালোবাসবে। আমরা জীবনে সফল হব । পরকালে আমরা মুক্তি ও জান্নাত লাভ করব।
কাজ : শিক্ষার্থীরা মহানবি (স.)-এর হাদিসের আলোকে নৈতিক ও অনৈতিক কার্যাবলির তালিকা তৈরি করে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে। |